যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর-বসুন্দিয়া) আসনের সংসদ সদস্য রণজিত কুমার রায়। আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের মেয়াদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে পারেননি। বরং নানা বির্তকের জন্ম দিলে দিনকে দিন নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন কেনার এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়েও দুই উপজেলার আওয়ামী লীগের কোন শীর্ষনেতাকর্মীকে দেখা যায়নি। বরং নাশকতা মামলার আসামি ও বিএনপির নেতাদের নিয়ে তিনি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন বলে অভিযোগ। এই সংক্রান্ত একটি ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যা নিয়ে ইতোমধ্যে যশোর-৪ আসন ছাড়াও যশোরের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ, রণজিত সংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ‘নিয়োগবাণিজ্যে’ পুনর্বাসিত করেছেন জামায়াত-বিএনপিদের। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত রাজাকারদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীকে নানাভাবে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ। ফলে দুই উপজেলা ও তৃণমূল নেতাকর্মীর সঙ্গে বিরোধ প্রকাশ্যে। দুই উপজেলায় শীর্ষ নেতাকর্মীদের নিয়ে এক মঞ্চে দেখা যায়নি দীর্ঘদিন।
বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলী বলেন, রণজিৎ রায় তো আওয়ামী লীগ করেন না। আওয়ামী লীগের সংগঠন করে না। তাই বর্তমান এমপি হয়েও দলীয় মনোনয়ন কেনার সময় দুই উপজেলার কোন শীর্ষ নেতাকর্মী তার সঙ্গে ছিলেন না। নিজের ক্ষমতা চালান বিএনপি ও জামায়াতের লোক দিয়ে। দুই উপজেলার যত নিয়োগ হয়; চাকরি দিয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের লোকজনদের। আমজাদ রাজাকারের পরিবারকে সমর্থন দিয়েছেন। বিষয়টি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকেও জানানো হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা তার পক্ষে নেই। দল যদি তাকে মনোনয়ন দেয়, সে ক্ষেত্রে কাজ করব; কিন্তু তার পক্ষে না। নৌকার পক্ষে। কিন্তু এলাকার জনগণ এমপি রণজিতকে চাচ্ছে না। সর্বশেষ ২০ নভেম্বর বিষয়টি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকের কাছে তার অভিযোগের ফিরিস্তি জমা দিয়েছি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন রণজিত কুমার রায়। বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার কারণ হিসাবে নেতাকর্মীরা বলেন, দুই উপজেলার সকল স্তরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিয়ে তিনি রাজনীতি করেছিলেন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে রণজিতের সঙ্গে অভয়রনগর ও বাঘারপাড়া উপজেলার নেতাকর্মীদের বিরোধ বাড়তে থাকে। এই বিরোধের কারণ হিসাবে নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, ক্ষমতায় এসে বাঘারপাড়া ও অভয়নগরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টাকার বিনিময়ে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি ও তার স্ত্রী নিয়তি রানী পর্যায়ক্রমে দুই উপজেলার অন্তত ৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। যা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এছাড়া প্রায় ১৫ বছর আওয়ামী লীগের ক্ষমতার মধ্যে তিনটি স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার প্রার্থীদের বিপরীতে তার অনুসারীদের প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিতেন। রাজনৈতিক নেতারা জানান, রণজিত রায়ের পছন্দের বাইরে গত তিন মেয়াদে বাঘারপাড়া ও অভয়নগর উপজেলার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। মোটা অংকের বিনিময়ে জামায়াত বিএনপির পদধারী ব্যক্তিদেরও তিনি নিয়োগ দিয়েছেন। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় একাধিকবার শিরোনাম হয়েছেন এই এমপি। দুই উপজেলাতে দলীয় নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করাতে এমপির সঙ্গে নানা কারণে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। রণজিত কুমার রায় তিনবারের এমপি হলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। দুই উপজেলায় নেতারা নানা দল, উপদলে বিভক্ত। দীর্ঘদিন ধরে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দিয়েই চলছে বাঘারপাড়া কমিটি। সভাপতি রণজিত রায়ের সঙ্গে এক মঞ্চে যান না দুই উপজেলার সভাপতি সাধারণ সম্পাদকরা। অন্য নেতারাও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন পৃথকভাবে।
দণ্ডিত রাজাকারদের মদদদাতা :
রনজিত রায়ের ছত্রছায়ায় থেকে বেপারোয়া হয়ে ওঠে বাঘারপাড়ার প্রেমচারা এলাকার ‘আমজাদ রাজাকার’ বাহিনী। ২০১৭ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে শেল্টার দিয়ে গেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য রণজিত রায়। সংসদ সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতায় একের পর এক বাদী, স্বাক্ষী ও স্বজনদের বাড়ি ভাংচুর, হত্যা হুমকির দিয়েছেন তারা। শুধু তাই নয়, যুদ্ধাপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দেয়ায় প্রাণ দিতে হয়েছে এক স্বাক্ষীর ভাইকে। এভাবে একের পর এক অভিযুক্তদের মদদ দেয়া ও চিহ্নিত রাজাকার আমজাদ মোল্যার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় বাঘারপাড়ার আওয়ামী লীগ নেতারা ছিলেন তার উপর ক্ষুব্ধ। বিভিন্ন সময় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন যশোরের সুশীল সমাজ ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ।
জেলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক সাজেদ রহমান বকুল বলেন, ‘আমজাদ রাজাকার যাতে এই মামলা থেকে রেহাই পায় সেজন্য এমপি রনজিত সকল চেষ্টা করে গেছেন। এমনকি তার ছত্রছায়াতে এই রাজাকার বাহিনী প্রেমচারা এলাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠে। স্বাক্ষী ও স্বজনদের হুমকি দিয়েছেন এবং তাদের উপর হামলা এবং মামলাও করিয়েছেন তিনি। যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি একাধিবার সংবাদ সম্মেলন ও প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন।
‘নিয়োগবাণিজ্যে’ পুনর্বাসিত জামায়াত-বিএনপি :
উপজেলা সদরের সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান বাঘারপাড়া ডিগ্রি কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ হিসেবে ২২ লাখ টাকার বিনিময়ে উপজেলা জামায়াতের রোকন আব্দুল মতিনকে নিয়োগ দিয়েছেন। হাবুল্ল্যা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছেন উপজেলা ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আজিজুর রহমানকে। রায়পুর কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছেন ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামানকে। ধলগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছেন ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমানকে। আগড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছেন বিএনপি নেতা হুমায়ন কবিরকে। ছাতিয়ানতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছেন যশোর সদরের ফতেপুর ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি শহীদুলকে। অভয়নগর উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আ. আজিজের কন্যা মহাছিনা খাতুনকে ২২ লাখ টাকার বিনিময়ে বাঘারপাড়া উপজেলা খাজুরা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসায় নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী নিয়োগে দুই উপজেলা থেকে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মী হয়েও সাত-আট লাখ টাকা দিয়ে চাকরি নিতে হয়েছে অনেককে। এসব তথ্য উল্লেখ করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটে ২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন বাঘারপাড়া ও অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ।
অবৈধ সম্পদের পাহাড় রনজিতের !
উপজেলা আওয়ামী লীগের দেওয়া তালিকা তথ্যে মতে, রনজিত কুমার রায় ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। তখন নির্বাচনী হলফনামায় স্থাবর ও আস্থাবর সম্পদের বিবরণ দেন। সেখানে পৈত্রিক চার বিঘা কৃষিজমি, চার শতক জমির ওপর তেলিধান পূজা মৌজায় একটি টিনের ঘর আছে বলে উল্লেখ করেন। ছেলে কিংবা স্ত্রীর নামে কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স বা জমি নেই। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর ১৫ বছরে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। নেতাকর্মীদের দেয়া তথ্যমতে, বর্তমানে এমপির নামে যশোর রেল রোডে পঞ্চম ও তিনতলা দুটি, যশোর লোহাপট্টিতে একটি, যশোর নিউ মার্কেটে দুটি, বাঘারপাড়া উপজেলায় দোতলা একটি, খাজুরা বাজারে চারতলা একটি, ঢাকার মিরপুর দারুস সালাম রোডে দুটি বাড়ি, ছেলেদের নামে ভারতে সল্ট লেক ও বারাসাতে দুটি বাড়ি, বাঘারপাড়া ও চৌগাছা উপজেলায় ২২৫ একর জমি এবং খুলনার ডুমুরিয়ায় ৫০ একর জমিসহ মৎস্য ঘের রয়েছে। নিজে পাজেরো গাড়িতে চড়েন, যার মূল্য এক কোটি টাকা। দুই ছেলে ও স্ত্রীর ব্যবহৃত তিনটি গাড়ির মূল্য ৯০ লাখ টাকা। এছাড়া স্ত্রীর নামে ১০টি ট্রাক-কাভার্ডভ্যান আছে, যার মূল্য পাঁচ কোটি টাকা।’ কীভাবে তিনি আকাশছোঁয়া সম্পদের মালিক হলেন? এই সংক্রান্ত একটি অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ নেতাকর্মীরা বিভিন্ন দপ্তরে পাঠিয়েছেন। এসব তথ্য লিখিতভাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দেয়া হয়েছে বলে বাঘারপাড়া শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসান আলী জানিয়েছেন।
মনোনয়ন ফরমসহ এমপি রণজিতের ছবি ভাইরাল :
নানা সময়ে আলোচনা সমালোচনার মধ্যে সর্বশেষ সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন এমপি রনজিত। ঢাকার ন্যাম ভবনে ওই ছবিতে এমপি রণজিতের সঙ্গে নাশকতা মামলার দুই আসামি ও যশোর বিএনপির দুই নেতাকে দেখা যায়। এই ছবি ছাড়াও আরও দুটি ছবিতে নাশকতা মামলার আসামিসহ কয়েকজন নেতাকর্মীকে নিয়ে এমপি রণজিতকে খাওয়া-দাওয়া করতে দেখা যায়। জানা গেছে, একাধিকবার যশোর-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের এমপি হওয়া রণজিত কুমার এবারও নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন। কিন্তু দলীয় নেতাকর্মীরা তাকে এড়িয়ে চলছেন। ১৯ নভেম্বর দলীয় মনোনয়ন ফরম কেনেন রণজিত কুমার। সেদিনই ঢাকার ন্যাম ভবনে একটি গ্রুপ ছবিতে রণজিত রায়ের পাশে বাঘারপাড়ার বর্তমান পৌর মেয়র কামরুজ্জামান বাচ্চু, পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলামকে দেখা যায়। শহিদুল ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল রাতে সদর উপজেলার চান্দুটিয়া গ্রামে নাশকতা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। ছবিতে এমপির সঙ্গে বাঘারপাড়া পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি এবং উপজেলা বিএনপি সদস্য আরিফ খান তুর্কিকেও দেখা যায়। তুর্কির বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট ও ১৪ জুনের দুটি নাশকতার মামলা আছে। এ ছাড়া ছবিতে থাকা বাঘারপাড়া পৌরসভার মহিরণ এলাকার জামির হোসেন ও সাজ্জাদ খন্দকার বিএনপি পরিবারের সদস্য বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন।
অভিযোগ বিষয়ে সংসদ রনজিতের বক্তব্য :
সকল অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য রনজিত রায় বলেন, আমার বিরুদ্ধে অনেকের অনেক অভিযোগ রয়েছে। অনেককিছু বলছে। আপনারা যা পারেন লিখতে পারেন। তিনি এসব বিষয়ে আর কোন মন্তব্য করবেন না বলে সংযোগ কেটে দেন।